প্রিন্স প্যারিস ও প্রিন্সেস হেলেন
ট্রয়ের রাজকুমার প্যারিস দৈব বর পেয়েছে, সবচেযে সুন্দরী রাজকন্যাকে বিয়ে করবে সে। কীভাবে কী হবে প্যারিস কিছুই জানে না। কিন্তু দৈব বর তো ফলতে হবে! তাই বুঝি একদিন শিকারে বেরুল রাজকুমার। জাহাজের পালে বাতাস লাগল। তরতর করে এগিয়ে চলল পশ্চিমে। আড়াআড়িভাবে ইজিয়ান সাগর পাড়ি দিল। সামনে নতুন দেশ। সাগরে ঘেরা ইউরোপের চমৎকার ভূখণ্ড–গ্রিস।
হেলেনের সাথে প্রথম দেখা
গ্রিসের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়িয়ে একদিন প্যারিস এল দক্ষিণ গ্রিসের ছিমছাম নগরী স্পার্টায়। তখন সমগ্র গ্রিস অনেকগুলো ছোট ছোট নগরীতে বিভক্ত ছিল। প্রতি নগরী ছিল এক একটি রাষ্ট্র। স্পার্টার রাজা মেনেলস রাজপ্রাসাদে প্যারিসের থাকার ব্যবস্থা করলেন। এখানেই রানী হেলেনের সঙ্গে প্যারিসের পরিচয়। সুন্দর শ্রেষ্ঠা হিসেবে হেলেনের তখন খুব নামডাক। দৈব বর বুঝি হেলেনের উদ্দেশেই করা হয়েছিল। তাই প্যারিস আর হেলেন দু জন দু জনকে পছন্দ করল। সুযোগ বুঝে একদিন প্যারিস হেলেনকে নিয়ে সোজা চলে এল নিজ দেশ ট্রয়ে।
ঘটনাটি ছিল গ্রিক জাতির জন্য অত্যন্ত অপমানজনক স্বাধীনচেতা গ্রিকরা এ অপমান সইবে কেন বিভিন্ন নগররাষ্ট্রের নেতারা একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নিলেন। ঠিক হল ট্রয় আক্রমন করে উচিত শিক্ষা দিতে হবে আর উদ্ধার করতে হবে হেলেনকে।
উত্তর ও দক্ষিণ গ্রিসের বিভিন্ন রাষ্ট্র মিলিতভাবে গড়ে তুলল এক বিরাট সৈন্যবাহিনী। যুদ্ধের নেতৃত্ব নিলেন রাজা মেনেলসের ভাই আগা মেম্নন। এই যুদ্ধে গ্রিকদলের প্রধান বীর ছিলেন তরুণ যোদ্ধা একিলিস। অন্যদিকে ট্রয়ের পক্ষে বিখ্যাত যোদ্ধা হেকটর। একটানা দশ বছর ট্রয়ের প্রান্তরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে হেক্টরের মৃত্যু হয়। যুদ্ধ গ্রিসের অনুকূলে হলেও এতে চূড়ান্ত কোনো ফলাফল দেখা দেয় নি। ট্রয়ের যখন কোণঠাসা অবস্থা তখন আত্মরক্ষার জন্য ট্রয়বাসীরা দেয়ালঘেরা নগরের তোরণ বন্ধ করে দিয়েছিল। সুতরাং গ্রিকদের পক্ষে নগরে প্রবেশ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
প্রতিশোধ না নিয়ে ফিরে যাবে না, এই ছিল গ্রিকদের সঙ্কল্প। তাই নতুন কৌশল বের করার জন্য সবাই বৈঠকে বসল। সবশেষে ইথাকার রাজা ইউলিসিস এক উপায় বের করলেন। তৈরি করালেন প্রকাণ্ড এক কাঠের ঘোড়া। ঘোড়ার পেটে প্রবেশ করল নামীদামি চল্লিশ জন যোদ্ধা। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। সব কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে এক চালাকচতুর গ্রিককে বেঁধে দিল ঘোড়ার পায়ের সঙ্গে। এবার পুরো গ্রিক বাহিনী ফিরে গেল জাহাজে। জাহাজ এগিয়ে চলল সামনে –যেন গ্রিকরা ফিরে যাচ্ছে নিজ দেশে।
ট্রয় নগরীর লোকেরা এবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। গ্রিকরা নিশ্চয়ই রণে ভঙ্গ দিয়েছে। সাগরতীরে কাঠের ঘোড়াটি দেখে দারুণ কৌতুহল হল। তারা এগিয়ে এল কাছে। ঘোড়ার সাথে বাঁধা গ্রিক সৈন্যটির কাছে জানতে পারল গ্রিকরা ফিরে গেছে। যাত্রা যাতে শুভ হয় তাই নাকি ওকে আর ঘোড়াটিকে উৎসর্গ করে গেছে দেবতাদের উদ্দেশে। সব কথা ওরা সরল মনে বিশ্বাস করল। ঘোড়াসহ গ্রিক সৈন্যটিকে নিয়ে এল নগরে।
ধ্বংস হলো ট্রয়
নগরবাসীরা সব শুনে বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠল। রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত সে আনন্দের ঢেউয়ে রমরমা হয়ে রইল চারদিকে। ধীরে ধীরে রাত গভীর হল – একসময় অনেক ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল ট্রয় নগরী। এবার চালাক গ্রিক সৈন্যটি কাজে লেগে গেল। চুপিচুপি তোরণের বাইরে এল। ঘাস-পাতা জড়ো করে আগুন জ্বালাল। সাগরে গ্রিক জাহাজগুলো এই সঙ্কেতেরই অপেক্ষায় ছিল। এবার পাল ঘুরাল। রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে তারা ফিরে এল ট্রয়ের মাটিতে। এদিকে সেই গ্রিক সৈন্যটি এসে কাঠের ঘোড়ার গায়ে মৃদু আঘাত করল। সঙ্কেত পেয়ে বেরিয়ে এল চল্লিশ যোদ্ধা। এবার ঘুমন্ত ট্রয় নগরীতে একযোগে আক্রমণ করল তারা। এমন হঠাৎ আক্রমণে ট্রয়বাসীরা একেবারে অসহায় হয়ে পড়ল। একতরফা যুদ্ধে গ্রিকরা শুধু জয়ীই হল না—এতকালের সমৃদ্ধ নগরী ট্রয়কে ধ্বংস করে ফেলল।
গ্রিসের মহাকবি হোমার খ্রিষ্টপূর্ব আট শতকে মহাকাব্য ইলিয়ড লেখেন। এই কাহিনীটি ইলিয়ড থেকেই নেওয়া। তার সময়ের আরো চার শ বছর আগের গ্রিসকে নিয়ে নাকি গড়ে উঠেছে এই মহাকাব্য। কাহিনী নিছক কাহিনীই নয়। এ সমস্ত কাহিনীর ভেতরেই হয়তো লুকিয়ে থাকতে পারে ইতিহাসের কোনো সত্য। তাই বুঝি এই সত্য খুঁজে বের করতে এগিয়ে এলেন হাইনরিখ শ্ৰীমান। তিনি একজন জার্মান। শৌখিন প্রত্নতত্ত্ববিদ। তিনি এশিয়া-মাইনরের উত্তরাঞ্চলে ইজিয়ান সাগরের তীরবর্তী ‘ইলিয়াম’ অঞ্চলে ব্যাপক খনন করলেন। আঠার শ সত্তর থেকে তিয়াত্তর খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এগিয়ে চলল তার কাজ। অবশেষে তিনি সফল হলেন। মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে এল এক সমৃদ্ধ নগরীর ধ্বংসাবশেষ। নিশ্চিন্ত হলেন—এই সেই হোমারের ট্রয় নগরী। অবশ্য হোমারের কাহিনী কতটা সত্য তা নির্ধারণ করা যায় নি। হতে পারে কিছুটা সত্যের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে কবি প্রচলিত কিংবদন্তিকে আশ্রয় করে কাহিনী তৈরি করেছেন। কবির কল্পনার রঙে তা হয়তো আরো বর্ণিল হয়েছে। তবে কিংবদন্তির আশ্রয় হলেও হোমার অপূর্ব দক্ষতায় গ্রিসের সেই যুগটির বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। ভৌগোলিক দিক থেকে গ্রিস অনুর্বর পাহাড়-পর্বতে ঘেরা। সে কারণেই ওখানে কৃষিভিত্তিক সভ্যতার জন্ম হতে পারে নি। মানুষগুলো গড়ে উঠেছে যোদ্ধা হিসেবে। কারণ বেঁচে থাকার জন্য তাদের বিভিন্ন দেশে আক্রমণ করতে হত। অপরদিকে এশিয়া-মাইনরের বিভিন্ন অঞ্চল পুরোনো যুগ থেকেই কৃষিভিত্তিক সভ্যতা গড়ে তুলেছে। খাদ্য সমস্যা এখানে কম বলেই হয়তো এসব অঞ্চলের মানুষ যুদ্ধবিদ্যাকে অত গুরুত্ব দেয় নি। সুতরাং ইতিহাস থেকেই ধারণা নেওয়া যায় গ্রিস আর ট্রয়ের মানুষদের মধ্যে দুই ভিন্ন চরিত্র ছিল। আর ট্রয়ের যুদ্ধের কাহিনীর মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এই সত্যটিই ফুটে উঠেছে। শ্রীমানের আবিষ্কার করা ট্রয় থেকে হোমারের কাহিনীর হয়তো সম্পূর্ণ সত্যতা বিচার করা যাবে না; তবে ট্রয় নগরীর ধ্বংসাবশেষ থেকে যে প্রমাণপত্র বেরিয়ে এসেছে তাতে সহজেই ধারণা নেওয়া যায় কোনো একসময় গ্রিকদের হাতেই ট্রয়ের পতন ঘটেছিল।
You must be logged in to post a comment.