সম্রাট দারায়ুস কে ছিলেন?
পারস্য সম্রাট দারায়ুসের নাম তখন সবার মুখে মুখে। তার শক্তির সামনে মাথা তুলে দাঁড়ায় অমন সাহস কার! এশিয়া মাইনরের চারপাশ তার অধিকারে। ক্রমে এগিয়ে এসেছেন ইউরোপে। গ্রিসের কিছু কিছু অঞ্চলও দখল করেছেন তিনি। আরো এগিয়ে যাবেন—সমগ্ৰ পৃথিবী আসবে অধিকারে, এই ছিল তার ইচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ হোঁচট খেলেন দারায়ুস! তার রক্তচক্ষুর সামনেও প্রতিবাদ! এত সাহস পেল কোথায়? গ্রিসের অন্তর্ভুক্ত কিছু রাষ্ট্র ছিল পারস্য সম্রাজ্যের অধিকারে। ওরাই দারায়ুসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। দারায়ুস খোঁজ নিয়ে জানলেন সে সময়ের সমৃদ্ধ গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্সই উৎসাহিত করেছে বিদ্রোহীদের। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে আরো কিছু নগররাষ্ট্র। বিদ্রোহ দমন করেই দারায়ুস সিদ্ধান্ত নিলেন গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলোকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে।
খ্রিষ্টপূর্ব চার শ বিরানব্বই সালের মধ্যেই পারসিকরা গ্রিসের মেসিডোনিয়া দখল করে। প্রথমেই দারায়ুস গ্রিসের বিভিন্ন নগররাষ্ট্রে প্রতিনিধি পাঠান। আহ্বান জানান তার বশ্যতা স্বীকার করতে। যারা পারস্যের অধিকার মেনে নেবে তারা যেন প্রমাণস্বরূপ নিজ নিজ দেশের মাটি আর পানি পাঠিয়ে দেয়। দারায়ুসের এই ঘোষণায় নগররাষ্ট্রগুলোয় আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। অনেকেই স্বীকার করে নেয় পারস্যের বশ্যতা। কোনো কোনো নগররাষ্ট্র অবশ্য প্রতিবাদ করে। এরা এই পরাধীনতা মেনে নেবে না। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এথেন্স আর স্পার্টা। নগরপ্রধানদের নির্দেশে দারায়ুসের প্রতিনিধিকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হল কুয়োর মধ্যে।
সব শুনে দারায়ুস প্রচণ্ড রেগে গেলেন। দু চোখে তার প্রতিশোধের আগুন। এক শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ার আদেশ দিলেন তিনি। ছয় শ জাহাজের এক বিরাট নৌবহর গঠিত হল। মাঝিমাল্লা মিলে প্রতি জাহাজে ছিল দুই শ সৈন্য। এমনি করে এক লাখ বিশ হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী এগিয়ে এল এথেন্সের দিকে।
দেশপ্রেম আনে স্বাধীনতা
ভয় পেল না এথেন্স স্বাধীনতা রক্ষা করতেই হবে। আলোচনায় বসলেন এথেন্সের বিজ্ঞ লোকেরা। তাদের হাতে মাত্র নব্বইটি জাহাজ। অত বড় গ্রিক বাহিনীর সামনে কেমন করে দাঁড়াবে! তবু ভয় পেলে চলবে না। এথেন্স নগরীর চব্বিশ মাইল দূরে ম্যারাথন উপসাগরে পারস্য বাহিনী নোঙর ফেলেছে। যে কোনো মুহুর্তে ঝাপিয়ে পড়বে। সুতরাং সময় নষ্ট করা চলে না।
স্পার্টার কাছে সাহায্য চেয়ে দূত পাঠাল এথেন্স। নির্ভরযোগ্য বিশ্বাসী দূত ফিডিপাইডিস এসে পৌছলেন স্পার্টায়। পারস্যের বিরুদ্ধে সাহায্য পাঠাতে স্পার্টার আপত্তি নেই। তবু সমস্যা দেখা দিল। স্পার্টাবাসীরা প্রচণ্ড ধর্মভীরু। ধর্মীয় সংস্কারে আচ্ছন্ন তাদের মন। পুরোহিতরা পুঁথিপত্র ঘেঁটে জানাল পূর্ণিমার আগে যুদ্ধযাত্রা অমঙ্গল। তখন সবে নবমীর তিথি। সুতরাং বিফল হয়ে ফিরে এল ফিডিপাইডিস। স্পার্টার রাজা অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিলেন পূর্ণিমার পরপরই সাহায্য পাঠাবেন।
এথেন্সবাসীরা জানত পূর্ণিমার আগেই পারস্য সৈন্যরা ঝাপিয়ে পড়বে। সুতরাং স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে নিজেদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ। দেশপ্রেমের শক্তি বুকে নিয়ে মাত্র নয় হাজার সৈন্য এগিয়ে গেল ম্যারাথনের দিকে।
কৌশল সংখ্যাকে হার মানায়
সামরিক শক্তি কম হলেও যুদ্ধকৌশলই ছিল এথেন্স বাহিনীর একমাত্র ভরসা। তারা সরাসরি সামনে না গিয়ে পাহাড়-পর্বতের আড়ালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অগ্রসর হল। অবশেষে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল চূড়ান্ত সময়। খ্রিষ্টপূর্ব চার শ নব্বই সালের সেপ্টেম্বর। ম্যারাথন প্রান্তরে শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। প্রচণ্ড যুদ্ধ কিন্তু হঠাৎ করে শুরু হয়ে হঠাৎই যেন থেমে গেল। সবার অবাক দৃষ্টি আছড়ে পড়ল ম্যারাথনের ময়দানে। পারস্য বাহিনীর পরাজয় ঘটেছে – পরাজয়ের কলঙ্ক নিয়ে তারা জাহাজ ফেরাল নিজ দেশে। পেছনে ফেলে গেল ছয় হাজার পার্সীয় যোদ্ধার মৃতদেহ। অপর পক্ষে এথেন্স হারাল তার এক শ দেশপ্রেমিক যোদ্ধা।
এমন বিজয়ে এথেন্সের যোদ্ধারাও কম অবাক হয় নি। দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করেছে তারা। আনন্দ উপচে পড়ছে! এথেন্স নগরীতে দ্রুত এই আনন্দ সং পৌছানো দরকার। এবারও ভার নিলেন ফিডিপাইডিস। ম্যারাথন থেকে ছাব্বিশ মাইলের পথ এথেন্স। আনন্দের সবুজ পাখি হয়ে তিনি ছুটতে লাগলেন। একটানা ছুটে অবশেষে পা রাখলেন এথেন্সের মাটিতে। উৎকণ্ঠিত নগরবাসীকে শোনালেন বিজয়ের সংবাদ –স্বাধীনতা রক্ষার আনন্দ। কিন্তু পথচলার ক্লান্তিতে তিনি তখন অবসন্ন। আর দাঁড়াতে পারছেন না। লুটিয়ে পড়লেন দেশের প্রিয় মাটিতে। চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়লেন ফিডিপাইডিস। ম্যারাথনের পবিত্র স্মৃতি নিয়ে এ লেখার নাম হল ম্যারাথন রেস। যার পরিধি ছাবিশ মাইল।
ম্যারাথনের যুদ্ধে এথেন্সবাসীর এই বিজয়ে সবাই অবাক হয়েছে। বিশ্ব বিজয়ী পারস্য বাহিনীর বিরুদ্ধে গুটিকয়েক যোদ্ধার অমন বিজয় কী করে সম্ভব! এর উত্তর কিন্তু আরো মজার। সে যুগে একমাত্র এথেন্সে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গণতন্ত্র। রাষ্ট্রের প্রতিটি কাজে জনসাধারণের মতামত গ্রহণ করা হত। ফলে দেশের জন্য ভালবাসাও গভীর হয়েছিল এথেন্সবাসীদের। যখন স্পার্টার কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া গেল না তখন এথেন্সের নেতারা জনসাধারণের সভা ডেকে পরামর্শ চেয়েছিলেন। এই সভাই সিদ্ধান্ত দেয়, নগর আগলে বসে থাকা নয়—এগিয়ে যেতে হবে ম্যারাথনে। পণ্ডিতদের মতে ম্যারাথনে এগিয়ে না গিয়ে শুধু নগরে প্রতিরোধের আয়োজন করলে পারস্য বাহিনীর চাপ হয়তো এথেন্সবাসীরা সহ্য করতে পারত না। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল বলেই এথেন্সের যোদ্ধারা বেশি সাহসী হতে পেরেছিল। আর জনসাধারণের সঠিক সিদ্ধান্তের ফলেই রক্ষা পেয়েছিল স্বাধীনতা।
You must be logged in to post a comment.