দরিয়া-এ -নুরঃ বাংলার গৌরবময় হীরার কাহিনী

adx Ar
Adx AR

দরিয়া-ই-নূর

 অনেক পথ পেরিয়ে এল ঢাকায়

  

        ভারতে তখন ইংরেজ শাসন চলছিল। উনিশ শতকের মাঝপথের কথা। এ সময় ঢাকার নওয়াবদের অর্থ-বিত্ত আর শান-শওকতের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। খবর এল ভারতে মূল্যবান অলঙ্কার ও পাথরের নিলাম হচ্ছে। ইংরেজরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্য আক্রমণ করার সময় যেসব হীরা-জহরত লুট করেছিল কলকাতার হ্যামিন্টন এন্ড কোম্পানি। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সেসব মূল্যবান জিনিস নিলামের ব্যবস্থা করেছে। ঢাকার বিখ্যাত নওয়াব খাজা আলীমুল্লাহ ছুটে এলেন সেই নিলামে। এটা-ওটা পরখ করে দেখলেন, শেষ পর্যন্ত পছন্দ করলেন কোহিনূরের মতোই এক বড়সড় আকারের হীরা। ইতোমধ্যে হীরাটির সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল। গালভরা নামও ছিল এর। হীরাটির নাম দরিয়া-ই-নূর । অর্থাৎ ‘আলোর সাগর’। নওয়াব আলীমুল্লাহ সে যুগে পঁচাত্তর হাজার টাকায় কিনেছিলেন ‘দরিয়া-ই নূরকে’। একই নামের আরেকটি বিখ্যাত হীরা আছে পারস্যে। তবে আমাদের দরিয়া-ই-নূর ঢাকার নওয়াবদের। এখনো সোনালী ব্যাঙ্কে নওয়াবদের মূল্যবান অলঙ্কারের সঙ্গে জমা করা আছে।

 কোহিনুরের ছোট ভাই দরিয়া এ নুর

      কোহিনূরের মতো দরিয়া-ই-নূরও প্রথম পাওয়া গিয়েছে দক্ষিণ ভারতে। অলঙ্কার হিসেবে নওয়াবদের কাছে থাকা দরিয়া-ই-নূর একটি মাত্র হীরা নয়, মূল বড় হীরক খণ্ডের চারদিকে আরো দশটি ছোট ছোট হীরা বসানো রয়েছে। প্রথমে বেশ কিছুকাল দরিয়া-ই-নূর মারাঠা রাজার অধিকারে ছিল। পরে হায়দরাবাদের নওয়াব সিরাজুল মুলক এটি কিনে নেন। শেষ পর্যন্ত অনেক হাত ঘুরে হীরাটি আসে পাঞ্জাবে। রত্নপ্রেমিক শিখবীর মহারাজ রণজিৎ সিং পেয়ে যান দরিয়া-ই-নূরকে। রণজিৎ সিংয়ের মৃত্যুর পর একে একে তার উত্তরাধিকারী শের সিং এবং নেহাল সিংহের হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত আসে দিলীপ সিংহের হাতে। কিন্তু দিলীপ সিংহ আগলে রাখতে পারেন নি দরিয়া-ই-নূরকে। এই বালক রাজা উনিশ শতকের মাঝামাঝি ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে হেরে যান। আত্মসমর্পণ করেন। ইংরেজদের চাহিদামতো মহারানী ভিক্টোরিয়ার জন্য তিনি হীরাটি দিয়ে দিতে বাধ্য হন। ইংল্যান্ডে মহারানীর কাছে হীরাটি পৌঁছে ১৮৫০ সালের জুলাই মাসে।

         একসময় ইংরেজরা সিদ্ধান্ত নেয় ভারত থেকে সংগ্রহ করা সব রত্ন ভারতে এনে নিলামে বিক্রি করা হবে। তাই কোহিনূর আর কিছু সুন্দর মুক্তার মালা রেখে বাকি সব পাঠানো হয় ভারতে। এই সূত্রেই হ্যামিল্টন এন্ড কোম্পানির নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। যেখান থেকে নওয়াব আলীমুল্লাহ এই দরিয়া-ই-নূর কিনে নিয়েছিলেন।

        নওয়াব সলিমুল্লাহর আমলে ঢাকার নওয়াবদের জমিদারিতে সঙ্কট দেখা দেয়। আর্থিক অনটনের কারণে নওয়াব অনেক অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে দেন। ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে অনেক ঋণও গ্রহণ করেন। এই ঋণ শোধ করার জন্য তিনি একসময় দরিয়া-ই-নূরকে বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া হয় হ্যামিল্টন এন্ড কোম্পানিকে। কিন্তু তেমন দাম না ওঠায় হীরাটি বিক্রির চিন্তা বাদ দিতে হয়।

        নওয়াব সলিমুল্লাহর মৃত্যুর পর নওয়াব এষ্টেটের চিফ ম্যানেজারের দায়িত্বে চলে আসে দরিয়া-ই-নূর। তবে তার হেফাজত করার দায়িত্ব দেওয়া হয় হ্যামিল্টন এন্ড কোম্পানিকে। অবশ্য এ জন্য কোম্পানিকে প্রতি বছর নওয়াব এস্টেট ফি দিত ২৫০ টাকা ।

        ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার আগে কলকাতার হ্যামিন্টন এন্ড কোম্পানির কাছ থেকে নওয়াব পরিবারের সদস্যরা দরিয়া-ই-নূরকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। অনেক যত্নে এই মূল্যবান হীরাটিকে রাখা হয় ‘ইম্পেরিয়াল ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া'র ঢাকা শাখায়। এর মধ্যে নওয়াব পরিবারের কেউ কেউ হীরাটি বিক্রির জন্য একবার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। কিন্তু খাজা নাজিমউদ্দিন বিরোধিতা করায় তা আর সম্ভব হয় নি।

        একসময় ইম্পেরিয়াল ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া বন্ধ হয়ে গেলে দরিয়া-ই-নূর আসে স্টেট ব্যাঙ্ক অব পাকিস্তানের হেফাজতে। পরে এই হীরাটিকে রাখা হয় ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অব পাকিস্তানের সদরঘাট শাখায়। বাংলাদেশ আমলে এই ব্যাঙ্কটিই হয়ে যায় সোনালী ব্যাঙ্ক। অদ্যাবধি এই ব্যাঙ্কের হেফাজতেই আছে দরিয়া-ই-নূর।

        সত্তরের দশকে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর একবার উদ্যোগ নেয় হীরাটি সংগ্রহ করার। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে গঠিত কমিটি দরিয়া-ই-নূরের মূল্য নির্ধারণ করেন পাঁচ লক্ষ টাকা। কিন্তু নানা জটিলতায় শেষ পর্যন্ত জাদুঘর হীরাটি সংগ্রহ করতে পারে নি। ব্যাঙ্কের গোপন বাক্সে থেকেও দরিয়া-ই-নূর এখনো তার গৌরবের কথা প্রচার করছে। বৃদ্ধি করছে ঢাকার নওয়াবদের মর্যাদা। এই উপমহাদেশের কোহিনূর দেশান্তরী হলেও দরিয়া-ই-নূর শুধু উপমহাদেশে নয় খোদ ঢাকাতে থেকে আমাদেরও অহঙ্কার বাড়িয়েছে বহুগুণ

adx ar

Enjoyed this article? Stay informed by joining our newsletter!

adx ar
Comments

You must be logged in to post a comment.

adx ar
POPULAR ARTICLES
About Author