কোহিনুর হীরার অন্তর্ধান

adx Ar
Adx AR

আলোর পাহাড়ঃকোহিনুর হীরা

 

  

        এক বিশাল রাজপুরী। জমকালো রাজকন্যার ঘর। মণিমাণিক্যে খচিত খাট। শুয়ে আছে অপূর্ব সুন্দরী রাজকন্যা। গলায় মুক্তোর মালা, কানে হীরের দুল। ঝলমলে শাড়িতে নানারকম বর্ণিল মোতি খচিত। ...রাজার দরবার ঘর। দামি হীরা-পান্নাজহরত খচিত সিংহাসন। রাজা পায়ের ওপর পা রেখে বসে আছেন সিংহাসনে। ঝলমল করছে তার মুকুটের হীরা। বহুমূল্য মণিমুক্তা শোভা পাচ্ছে তার রেশমি পোশাকে। অথবা আলীবাবা চল্লিশ চোরের গল্প।.দস্যুরা পাহাড়ের গায়ে টোকা দিয়ে বলল,‘ চিচিং ফাঁক’। আর অমনি ঘর ঘর করে সরে গেল পাথরের দেয়াল। ভেতরে রাজ্যের মণিমাণিক্য, হীরা-জহরত !

        ছোটবেলার মনকাড়া সব গল্পেই একটি বড় জায়গা জুড়ে আছে হীরা-পান্নামণিমাণিক্যের কথা। এতে বোঝা যায় এসব মূল্যবান পাথর সব যুগে সব দেশের মানুষের মনেই দোলা দিত। শুধু রূপকথা নয়—হীরা-পান্না, মণিমুক্তার কদর সব যুগের মানুষের মধ্যেই রয়ে গেছে। মূল্যবান এসব পাথর পাওয়া যায় পাহাড়ের গায়ে-খনির ভেতরে—এমনি নানা প্রাকৃতিক অবস্থায়। পৃথিবীর যেসব দেশে হীরা পাওয়া যায় তার মধ্যে ভারতের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভারতের এই সুনাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে একটি মহামূল্যবান হীরা। এই হীরাটির নাম বললেই সবাই চেনে। এর নাম ‘কোহিনূর’। কারো কারো কাছে কোহিনূর মণি।

        কোহিনূর নামের হীরাটি প্রথম কোথায় পাওয়া যায় এ নিয়ে নানা মত রয়েছে। কারো মতে ভারতের অন্ধ প্রদেশে পাওয়া গিয়েছিল এই মূল্যবান হীরা। এই প্রদেশের গন্টুর শহরের কাছে বয়ে চলছে কৃষ্ণা নদী। কৃষ্ণর তীরে কোলুর নামের এলাকায় পাওয়া যায় কোহিনূর। কেউ বলেন, না- কৃষ্ণা নয়, গোদাবরী নদীর তীরে মসলিপওমের কাছে পাওয়া গিয়েছিল হীরাটি। দুটো মতকে ধরে নিয়ে বড় করে বলা যাবে দক্ষিণ ভারতেই প্রথম পাওয়া গিয়েছে কোহিনূর।

        কোহিনূর পাওয়ার পর প্রথম কার কাছে আসে এ নিয়েও রয়েছে নানা কাহিনী। নানা কিংবদন্তি। বলা হয় মহাভারতের বীররাজা কর্ণের কাছে ছিল কোহিনূর মণি। এরপর কিংবদন্তি থেকে বেরিয়ে এসে প্রাচীন ভারতের রাজা বিক্রমাদিত্যের নামের সাথে জড়ায় কোহিনূর হীরার নাম। তাইতো, ভারতের এই খ্যাতিমান রাজা ছাড়া আর কার কাছে থাকতে পারে কোহিনূর!

        ইতিহাসের সূত্র থেকে জানা যায়, বিক্রমাদিত্যের পর নানা হাত ঘুরে কোহিনূর এসে জায়গা করে নেয় মালবদেশের রাজাদের রত্নভাণ্ডারে। অবশ্য তখনো এটি ছিল একটি আকর্ষণীয় হীরা। কোহিনূর নামটি দেওয়া হয়েছে আরো অনেক পরে। কেমন করে হীরাটি মালবের রাজাদের কাছে এল, সে সম্পর্কে ইতিহাস নীরব। তবে এর পরের কাহিনী মোটামুটি স্পষ্ট।

        তখন বিখ্যাত সুলতান আলাউদ্দিন খলজীর শাসন চলছে ভারতে। মালব অভিযানের পর সুলতানের দরবারে চলে আসে কোহিনূর। পরে মালবরাজের সঙ্গে সুলতান আলাউদ্দিন খলজীর চুক্তি হয়। সেই সূত্রে কোহিনূর ফিরে যায় আবার মালবে। ভারতে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত হীরাটি মালবেই থেকে গিয়েছিল।

        পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের জয়লাভের মধ্য দিয়ে ভারতে সূচনা ঘটে মোগল সাম্রাজ্যের। পানিপথে বাবর যুদ্ধ করেছিলেন দিল্লির সুলতান ইব্রাহীম লোদীর সঙ্গে। ইব্রাহীম লোদীকে সাহায্য করেছিলেন মালবরাজ বিক্রমজিৎ। বিক্রমজিৎ যদ্ধে নিহত হন। সম্রাট বাবরের ছেলে হুমায়ুন আগ্রায় বিক্রমজিতের পরিবার-পরিজনদের বন্দি করেন। তাদের ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য প্রচুর হীরা-জহরত দেওয়া হয় হুমায়ুনকে। এসব মণিমাণিক্যের সঙ্গে মোগলদের হাতে চলে আসে কোহিনূর। সেই থেকে দীর্ঘদিন কোহিনূর থাকে মোগলদের কাছে।

        মোগলদের পতনের যুগে পারস্যের সম্রাট বারবার আক্রমণ করেন ভারত। কোহিনূরের প্রতি লোভ ছিল পারস্য সম্রাট নাদির শাহের। তিনি দিল্লি আক্রমণ করে মোগলদের কোষাগার থেকে প্রচুর ধনরত্ন লুটে নিলেন। এখানেই তিনি প্রথম দেখলেন কল্পনার হীরাটিকে। জ্বলজ্বল করে উঠল পারস্য সম্রাটের হাতে। নাদির শাহের মুখ থেকে বেরিয়ে এল একটি শব্দ-“কোহিনূর”..। অর্থাৎ আলোর পাহাড়। সেই থেকে এই অবাক করা হীরাটির নাম হয়ে গেল কোহিনূর। নাদির শাহের সঙ্গে ভারতের কোহিনূর চলে এল পারস্যে। নাদির শাহের পর কোহিনূরের মালিক হলেন তাঁর ছেলে শাহরুখ। এই বিখ্যাত হীরার প্রতি লোভও ছিল অনেকের। কোহিনূরের আশায় সামন্ত রাজা আগামোহাম্মদ তীর্থযাত্রীর বেশে এলেন মিশা শহরে। রাজ্য হারিয়ে শাহরুখ তখন এই শহরের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করছিলেন। শাহরুখকে বন্দি করলেন আগামোহাম্মদ। কোহিনূরের খোঁজ পাওয়ার জন্য তার ওপর অনেক অত্যাচার করা হল। এবার শাহরুখকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন আফগানরাজ আহম্মদ শাহ আবদালী । মুক্ত হলেন শাহরুখ। শাহরুখ খুশি হয়ে কোহিনূরটি উপহার দিলেন আহম্মদ শাহ আবদালীকে।

        কিন্তু বেশি দিন ধরে রাখা গেল না কোহিনূর আহম্মদ শাহের পর আফগান সিংহাসনে প্রথমে বসলেন তৈমুর শাহ, পরে শাহ জামান। শাহ জামান গোপনে আগলে রাখলেন কোহিনূর। শাহ জামানকে বন্দি করে সিংহাসনে বসলেন ভাই শাহ সুজা। অনেক খোজাখুঁজি করে অবশেষে পাওয়া গেল কোহিনূর। কিন্তু শাহ সুজাওবা কত দিন আগলে রাখবেন কোহিনূরকে। এক দিন তার রাজ্যও গেল। রাজ্যহারা শাহ সুজা ও শাহ জামান আশ্ৰয় নিলেন পাঞ্জাবের বীর রণজিৎ সিংহের কাছে। এভাবে রণজিৎ সিংহের হাতে চলে আসে কোহিনূর।

        একসময় ভারতবর্ষ চলে যায় ইংরেজদের অধিকারে। পাঞ্জাবে শিখরা প্রতিরোধ গড়েছিল। কিন্তু ইংরেজদের হাতে তারা পরাজিত হয়। এভাবে পাঞ্জাবের ধনরত্ন চলে এল ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। এবার কোহিনূরের মালিক হয় ইংরেজ বণিক রাজারা। কোম্পানি ঠিক করল কোহিনূরটি উপহার দেওয়া হবে মহারানী ভিক্টোরিয়াকে। এমনি করে নানা হাত বদল হয়ে ভারতের কোহিনূর চলে এল মহারানী ভিক্টোরিয়ার কাছে। কোহিনূরের ওজন ছিল ২৮০ ক্যারেট। হীরা বিশেষভাবে কেটে কেটে উজ্জ্বলতা বাড়াতে হয়। রানী ভিক্টোরিয়া কোহিনূরকেও দক্ষ কারিগর দিয়ে কাটালেন। এবার এর ওজন হল ১০৯ ক্যারেট। ভিক্টোরিয়ার ইচ্ছে অনুযায়ী এখনো ইংল্যান্ডের রানীদের মুকুটে শোভা পাচ্ছে কোহিনূর হীরা।

adx ar

Enjoyed this article? Stay informed by joining our newsletter!

adx ar
Comments

You must be logged in to post a comment.

adx ar
POPULAR ARTICLES
About Author